তৃষ্ণা
তৃষ্ণা
১.
রফিক সাহেবের বাসার দরজা খুললেই একটা সাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ে;দৃশ্যটা যে সবাই দেখবে তা না...তবে অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়।
আমি ঢাকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছি। তবে আমার সাথে যদি কখনও আপনার দেখা হয়;আপনি নিঃসন্দেহে একটা ধাক্কা খাবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যে সাধারণ চেহারা সবার মানসপটে থাকে;আমার শুকনো ঠোঁট আর উসকোখুসকো চুলের সাথে তা না মেলাটাই স্বাভাবিক।
রফিক সাহেবের বাসার দরজা খোলা হয়ে গিয়েছে;তাই আমার পরিচয় সবিস্তারে এখনই দিতে পারছি না। তবে ঠিকই সময়ের সাথে বুঝতে পারবেন।
সাধারণ যে দৃশ্যটার কথা বলেছিলাম তার খানিক পরিবর্তন আজকে দেখছি। বরাবরের মতোই বাড়ির গৃহিণী দরজা খুলে কোমল হাসি দিলেও পেছনে ড্রইং রুমে রফিক সাহেবকে পায়ের ওপর পা তুলে পেপার পড়তে দেখলাম না। অবশ্য এ বাড়িতে আমি আসছি মোটে দু'মাস যাবৎ;তাতেই এত সুনির্দিষ্ট কাঠামো দাঁড় করানোটাও বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। ভদ্রলোকের অন্য কাজ থাকতে পারে। তাই হয়তো বাড়িতে নেই।
এই বাসায় আমি আসি ছাত্রী পড়াতে। রফিক সাহেবের মেয়ে তানিয়া নবম শ্রেণিতে পড়ে;ওকে নিয়মিত অংক শেখানো আমার কাজ।
গৃহিণীর নাম আমি জানি না। কাজেই ধরে নিন উনার নাম রাবেয়া। উনাকে দেখলেই উনার নাম রাবেয়া মনে হয়। তবে নাম দিয়ে আমার তেমন কোনো কাজও আসলে নেই;উনার সাথে আমার কথাবার্তা হয় চিরাচরিত ' আন্টি' সম্বোধন দিয়েই।
'সাধারণ দৃশ্যের' পরবর্তী ধাপ অনুযায়ী রাবেয়া আন্টি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,"কেমন আছো?"
আমি অমায়িক হাসি টেনে বললাম,"জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ্।"
বাসার মেঝেতে পিচ্ছিল মোজাইক। দিনে তিন-চারবার মোছা হয়। করোনার কারণে অতিরিক্ত সাবধানতার জন্য সংখ্যাটা দুই অংক বেড়েছে শুনেছি।
আমি বাসায় ঢুকলাম। ডাইনিং-এ আমার ছাত্রী বসে আছে। তার পাশে ছাত্রীর অনার্স পড়ুয়া বড় বোন;তৃষ্ণা।
তৃষ্ণা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়ছে। এ বাসায় যতো জন সদস্য তাদের সকলের সাথেই আমার যথেষ্ট সখ্যতা গড়ে উঠলেও তৃষ্ণার ক্ষেত্রে তেমনটা হয়ে উঠতে পারেনি। ঠিক কেন জানি সে আমাকে খানিক সন্দেহের চোখে দেখে।যতোক্ষণ তানিয়াকে পড়াই;ততোক্ষণ একটু পরপর উঁকি দিয়ে যায়।
তবে আজকে রীতিমতো যেভাবে আসন গেড়ে বসে আছে;তেমনটা কখনই হয় না।
তানিয়ার বরাবরের চেয়ারটা সাবধানে টেনে নিয়ে বসতে বসতে আমি জিজ্ঞেস করলাম,"কি খবর?"
তানিয়া সাবধানে নিঃশ্বাস ফেললো;তারপর বললো,"ভালো।"
এরকম মিনমিনে কণ্ঠে কথা বলার ব্যাপারটা নতুন। তানিয়া কখনই আস্তে কথা বলতে পারে না। ওর অভ্যাসই হলো মোটা কণ্ঠে চিৎকার করে কথা বলা।
আমি তৃষ্ণার দিকে তাকালাম। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। আমাকে খেয়াল করার খুব একটা প্রয়োজনীয়তা বোধ হয় সে করছে না।
তানিয়ার চোখে বিশালাকারের এক জোড়া ফ্রেমের চশমা। যদিও খানিকটা ফেটে গিয়েছে মনে হচ্ছে। বাম হাতে কলম দিয়ে আঁকাবাকা করে বিদ্যুৎ জাতীয় কিছু একটা সে আঁকানোর চেষ্টা করেছে।
অংক আজকে জমে উঠছে না;সম্ভবত সামনে আনকোরা একজন মানুষ বসে থাকার দরুণ। সূচকের মান বের করতে গিয়ে তানিয়া গুবলেট পাকিয়ে ফেললেও ওকে কড়া কিছু বলতে পারছি না। বড় বোন সামনে বসা অবস্থায় কঠিন কথা বলা আমার নিজের জন্যই অস্বস্তিদায়ক ঠেকে।
তৃষ্ণা হঠাৎ সোজা হয়ে বসে সরাসরি আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,"চা খাবেন?"
এভাবে সরাসরি বললে আসলে ভদ্রতা সূচক কিছু একটা বলা উচিৎ। কিন্তু আমি আজকে দ্রুত বললাম,"অবশ্যই।"
চেয়ারের পাশের থেকে ক্রাচটা নিয়ে তৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
তানিয়া ফিসফিস করে বললো,"স্যার একটা কথা বলি?"
না বললেও তানিয়া কথাটা বলবেই। কাজেই কথা না পেচিয়ে বললাম,"বলো।"
এবার তানিয়া মাথাটা একটু এগিয়ে এনে ষড়যন্ত্রীর ভঙ্গিতে বললো,"আপুকে আপনার কেমন লাগে?"
আমি ভ্রূ কুঁচকে তানিয়াকে দেখলাম। আমার উত্তর শোনার জন্য গভীর আগ্রহ তার চেহারা দিয়ে চুইয়ে পড়ছে। প্রায় সময়ই তানিয়া বিভিন্ন জটিল বিষয়বস্তু নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে,কথা বলতে বলতে নিজেই অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তখন বিশাল চশমার ওপাশে থাকা তার চোখ শূণ্য কিন্তু বিস্মিত অভিব্যক্তি নিয়ে চকচক করে। নিজের ভাবনায় নিজেই কুপোকাত আর কি!
তবে এরকম প্রশ্ন সে কখনই করেনি। অন্তত নিজের বোনের সম্পর্কে তো নয়ই।আমি কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতেই বললাম,"ভালোই।"
তানিয়া এবার একান ওকান হাসি দিলো।
"তাহলে এবার অন্তত হবে,"
আমি বললাম,"কি হবে?"
"কালকে আপুকে ছেলে পক্ষ দেখে গিয়েছে। এইবার মনে হয় ভালো কিছুই হবে।"
এতক্ষণে ব্যাপার খানিকটা ধরা গেলো। তৃষ্ণার বিয়ের জন্য ইদানিং বেশ কিছু সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু কোনোটাই পাকা হয়নি। যতোটুকু শুনেছি;ছোটবেলায় তৃষ্ণার পোলিও হয়ে ডান পা অকেজো হয়ে গিয়েছিলো। পাত্র পক্ষরা এসে মূলত এই ব্যাপারটা নিয়েই বেঁকে বসে।
"আপু কতো সুন্দর,তা-ও কোনো ছেলে ওকে পছন্দ করলো না", তানিয়া মন খারাপ করা কণ্ঠে বললো।
আমি মাথা নিচু করে অংক কষছি। তবে তানিয়ার কথা সত্য তা মেনে নিলাম।পয়লা বৈশাখে তৃষ্ণার ক্যাম্পাসে বাসন্তী রূপে যখন ওকে দেখেছিলাম;খানিকের জন্য হলেও হৃদয় শীতলতা অনুভব করে নি তা বলবো না।
আন্টি চা-এর কাপ নিয়ে এলেন। তানিয়া চোখ গোলগোল করে বললো," আপু কোথায়?"
আন্টির মুখ হাসি হাসি,"ও ঘরে;তোদের বাবা ফোন করেছিলো। সোহেলরা হ্যাঁ বলেছে।"
তানিয়ার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
আমি বললাম,"আমি তাহলে উঠি আজকে..."
আন্টি থামিয়ে দিলেন। বললেন,"বসো,তোমার আংকেল কে মিষ্টি আনতে বলেছি। মিষ্টিমুখ করে তারপর যাবে।"
ড্রইংরুমে বসে আছি। আমার সামনে রফিক সাহেব মনের সুখে পা দোলাচ্ছেন। সেন্টার টেবিলে চার পদের মিষ্টি সাজানো।
রফিক সাহেব গভীর তৃপ্তি নিয়ে বললেন,"একটা চাপ গেলো বুঝলে,বাবা।"
আমি স্মিত হাসি দিলাম। একটা মিষ্টিই খেয়ে শেষ করতে পারছি না। বাসায় উৎসবের মতো একটা আমেজ চলে এসেছে। তৃষ্ণা-তানিয়ার এক চাচা-চাচী বাড্ডা থেকে মিরপুর চলে এসেছেন মিষ্টি নিয়ে।
"ছেলে আর ছেলের ফ্যামিলি খুবই অমায়িক,জাস্ট আমার মেয়েটাকে চেয়েছে,"রফিক সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠলো।"এত ভালো সম্বন্ধ পাবো ভাবি নি জানো।
তুমি কিন্তু বাবা থাকবে বিয়ের কাজে। হাজার হোক,তোমাকে আমরা ছেলের মতোনই দেখি।"
আমি ভদ্রতাসূচক একটা হাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামাতে নামতে তৃষ্ণার সাথে মুখোমুখি হয়ে গেলাম। ক্রাচে ভর দিয়ে উঠছিলো;কোথায় গিয়েছিলো কে জানে।
আমি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে কয়েক ধাপ নেমে যেতেই তৃষ্ণা পেছন থেকে ডাক দিলো,"শুনুন।"
বিষয়টা আমার কাছে চমকে ওঠার মতোই। তৃষ্ণা সন্দেহের নজরে দেখা ছাড়া আমার সাথে কখনও কথা বলে না বললেই চলে। সেখানে এভাবে ডেকে বসার ব্যাপারটা কি!
আমি পেছনে ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। সে বললো,"আপনি কি আমাকে ভয় পান?"
কথায় খানিক হলেও সত্যতা আছে,কিন্তু সেটা তো আর স্বীকার করে ফেলা যায় না। কাজেই বলতেই হলো," আশ্চর্য...ভয় পাবো কেন!"
তৃষ্ণা বললো,"তাহলে আমাকে দেখলে কথা বলেন না কেন,চোখ নামিয়ে চলে যান দেখি।"
এই ধরনের প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় কিনা আমার জানা নেই। অত্যন্ত অস্বস্তিকর।
তৃষ্ণা এবার হাসি হাসি মুখে বললো,"একটা কাজ করে দেবেন?"
আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,"কি?"
"বর্ষা তো এসে গেলো,কদম ফুল যোগাড় করে দিতে পারবেন?এখনও তো মার্কেটে আসে নি। একেবার তাজা দরকার," তৃষ্ণা বলতে লাগলো,"হলুদে পরবো।"
আমি বললাম,"নিশ্চয়ই।"
তৃষ্ণা ঘুরে সিঁড়ি বাইতে ক্রাচে ভর দিলো। উঠতে যাওয়ার আগে আবার থেমে গিয়ে বললো,"আপনি আমাকে কংগ্রাচুলেশনস জানাবেন না?"
আমি একটু হাসলাম,মেয়েটা কথা ভালোই পাকাতে জানে।
"অভিনন্দন।"
তৃষ্ণা এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। চিরাচরিত সন্দেহবাতিক দৃষ্টি না;ওর এই দৃষ্টির সাথে আজকের আগে আমার পরিচয় হয় নি। সন্তর্পণে মাথা নিচু করে সিঁড়ি বাইতে শুরু করলো সে।
বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে,সাথে খুব ছোট ছোট ফোটার বৃষ্টি। মুষলধারেই নামার প্রস্তুতি। এখান থেকে আমার হোস্টেল এক ঘণ্টা। পকেটে টাকা থাকলেও আজকে কেন যেন ভিজতে ইচ্ছে করছে। একবার ভেঝার ধাক্কা নির্ঘাত জ্বর। কিন্তু এরপরও আমি আজকে ভিজবো।
ছোটবেলায় মন খারাপ হলে নাকি বৃষ্টিতে ভিজতাম। আমার মনে নেই;কিন্তু নানুর কাছে শুনেছি,আমার বাবা-মা যেদিন মারা গেলেন সেদিন নাকি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিলো। সে কারণেই হয়তো মন খারাপ হলে বৃষ্টির সাথে আমি একটা আত্মিক টান অনুভব করি।

কোন মন্তব্য নেই