সোমপুরের স্মৃতি
গত ডিসেম্বরে কনকনে শীতে ব্যাচের একদল সহপাঠীর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের লাল ইমারতে নানা ভঙ্গিমার ছবি ফেসবুকে দেখে ঠিক করেছিলাম,নতুন দশকের উদ্বোধনী ভ্রমণটা আমিও জগদ্বিখ্যাত 'সোমপুর মহাবিহার' ঘুরেই করবো।হুট করে বেড়িয়ে পড়া আমার ধাঁতে নেই;কাজেই জানুয়ারিতে বেশ পোক্ত একটা দিন ঠিক করে পাহাড়পুর ভ্রমণের পরিকল্পনা হয়ে গেল। পরিকল্পনায় শুরুতেই দলে ভীড়ে গেল ডিপার্টমেন্টের বন্ধু রাশেদ।এরপর সঙ্গী হলো স্বপ্নীল এবং ভূতত্ত্ব বিভাগের আমাদের একই ব্যাচের তিশাদ।
আমাদের এই ছোট্ট ট্যুরিস্ট গ্রুপের প্রত্যেক প্রাণীই নিশাচর শ্রেণির হওয়ায় যাত্রার নির্ধারিত দিন ২৯শে জানুয়ারি সকাল ন'টায় আমাদের বের হওয়ার কথা থাকলেও আমরা একেকজন ঘুম থেকেই উঠেছিলাম দশটায়(!)।হাজার হলেও সেদিন ছিলো ছুটিরদিন,তার ওপর হালকা শীত তো আছেই। কিন্তু এরপরও দ্রুত তৈরি হয়ে আমি,তিশাদ আর স্বপ্নীল ভদ্রা মোড় থেকে নওগাঁগামী বাসে উঠলাম।কথা ছিলো রাশেদ ভদ্রায় এসে আমাদের সাথে যোগ দেবে কিন্তু আধ ঘণ্টায়ও ওর কোনো হদিস না থাকায় বাধ্য হয়েই আমাদের রাশেদকে ছাড়াই রওনা হতে হয়েছিলো।
দলের 'অঘোষিত সর্দার' স্বপ্নীল।আমাদের মাথায় মাঝেমাঝে ঘোরাঘুরির পোকা নড়ে উঠলেও,স্বপ্নীলের মাথায় সেটা এক প্রকার দৌড়ের ওপরই থাকে বলা যায়।প্রায়ই সাত সকালে ফেসবুকে ঢুকে দেখা যায় স্বপ্নীল লালন আখড়ায় সুরের তালে তালে কোমর দোলাচ্ছে কিংবা কোনো বান্ধবীর বাড়িতে বসে দাওয়াতী পায়েস খাচ্ছে।ফলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ওরই সবচেয়ে বেশি।এই অভিজ্ঞতায় ভরসা করে আমরা ৫০ টাকা জন প্রতি ভাড়ার লোকাল বাসে বিভিন্ন স্টপে থামতে থামতে নওগাঁ জেলা সদরের দিকে আগাচ্ছিলাম এবং রাজশাহী থেকে আমাদের বহুক্ষণ পরে রওনা দেয়া রাশেদ বিআরটিসির বাসে চেপে আমাদের একঘণ্টা আগেই নওগাঁ পৌঁছে গিয়েছিল।
নওগাঁ জেলা সদরে আমাদের ত্রিভুজাকৃতির দল চতুর্ভুজ হলো এবং আমরা ক্রমান্বয়ে আরো দু'টো বাস বদল করলাম।তিনঘন্টায় তিনটি বাসে চেপে দুপুর দুইটায় আমরা যখন পাহাড়পুর গ্রামে পৌছালাম ততক্ষণে সূর্য আমাদের ওপর গোলা বারুদ ফেলতে শুরু করে দিয়েছে।কিন্তু এরপরও পাহাড়পুর বাজার থেকে ভ্যানে মূল বিহারের পাশ দিয়ে ফটকের কাছে যেতে যেতে যে শিহরণ আমরা অনুভব করছিলাম তার তীব্রতা রাশেদের কাচকলা হাসিই বলে দিচ্ছিলো।তাছাড়া পাহাড়পুর বাজারেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়ায় আমাদের মধ্যে থেকে বাস জার্নির ক্লান্তিও কমে গিয়েছিলো।
বিহারে প্রবেশ টিকেট ১০০ টাকা। বিহারের বাইরে দাঁড়ানো অবস্থায়ই এর ভেতরের পাহাড় সদৃশ মূল মন্দিরটি যেন আমাদের পাহাড়পুর গ্রামের নামকরনের সার্থকতা বুঝিয়ে দিচ্ছিলো।কাজেই এক প্রকার ফুরফুরে মেজাজেই আমরা বারোশ বছর আগের এই পালকীর্তিতে প্রবেশ করলাম।
বিহারের রক্ষা প্রাচীর ঘেষে প্রথমেই পড়ে ছোট ছোট বর্গাকৃতির কক্ষের ধ্বংসাবশেষ ।এগুলোতে নাকি তখনকার ছাত্র শিক্ষকরা থাকতেন।অনেকটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর আবাসিক হল এর মতো আরকি!যদিও তিশাদ বলেছিলো এতো ছোট রুমে ওকে পয়সা দিয়েও রাখা সম্ভব না।
এর খানিক সামনেই চুল্লির মতো দেখতে একটি কাঠামো।কাঠামোর নীচের অংশে আগুন দেয়ার খোপ দেখে আমরা আন্দাজ করলাম সেটা রান্নাঘরই।'চুলোয় যাওয়া'র আহ্বান আমরা প্রত্যকেই নিজ নিজ মা জননীর কাছ থেকে অহরহ পেয়েছি।তাই এমন পরিত্যক্ত চুলা পেয়ে তাতে বসে ধ্যান মগ্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলার লোভ আমরা কেউই সামলাতে পারি নি।
মূল মন্দির রীতিমতো হা করে তাকিয়ে থাকার মতো।অন্তত আমাদের দলের ইতিহাসবেত্তা তিশাদ সেটার দিকে হা করেই তাকিয়ে ছিলো।সারা জীবন ছবিতে দেখা পুরাকীর্তি স্বশরীরে দেখার উত্তেজনা নিয়ে আমরা মন্দিরের সিড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলাম।মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা নানা রকম প্রাণী,নর-নারীর টেরাকোটা আমাদের প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক প্রাচুর্যের চিত্রই দিচ্ছিলো।গোটা মন্দির তিন ধাপে ক্রমশঃ উঁচু হয়েছে।মন্দিরের দ্বিতীয় স্তরে উঠে সমগ্র মহাবিহারের সার্বিক দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে চলে এলো।সারা মহাবিহার সবুজ ঘাসে বেষ্টিত।সেই সবুজের মাঝে নিয়মিত বিরতিতে একেকটি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ।প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান নেই বলে হয়তো আমরা পুরাকীর্তিটির তাত্ত্বিক সৌন্দর্য তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে অক্ষম ছিলাম কিন্তু সদ্য আগত অপরাহ্নের মিষ্টতায় এ পরিবেশ আমাদের চারজনকেই খানিক সময় কবি বানিয়ে ফেলেছিলো।শীঘ্রই সম্মিলিত কাব্য সংকলন বের করবো ভাবছি আমরা।
মন্দিরের সিড়ি গুলো যথেষ্ট মসৃণ।পা একবারের পিছলে গেলেই কোমর থেকে দু-একটা হাড় কমে যাবে জেনেও আমরা মন্দিরের বিভিন্ন উঁচু অংশে উঠে ছবি তুললাম।বিশেষ করে স্বপ্নীলকে তো এক প্রকার বৈরাগ্যেই পেয়ে বসলো।বিভিন্ন জায়গায় পদ্মাসনে বসে চোখ বুজে আমাদের জানিয়েই দিলো সে বাকি জীবন এখানেই ধ্যান করে কাটিয়ে দেবে।
মন্দিরের খানিক দূরেই পরিত্যাক্ত পাত কুয়ো।কুয়োর মধ্যে উঁকি দিয়ে আমরা পানির নীচের লতাপাতা ছাড়া আর তেমন কিছু দেখি নি।তবে এই কুয়োই যে সমস্ত বিহারের পানির যোগান দিতো তাতে সন্দেহ নেই।এক পাশে আছে গন্ধেশ্বরীর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।মন্দিরের সামনে স্থাপিত তথ্য বোর্ড থেকে জানতে পারলাম মন্দিরটি বাংলায় মুসলমান শাসনামলের শুরুর দিকে নির্মিত।
বেলা বেশ পড়ে আসার কারণে আমরা বিহারের জাদুঘরটি দেখতে পারলাম না।তবে বিহার থেকে বের হয়ে এর মূল ফটকের বাইরে সারি হয়ে বসা দোকান গুলো থেকে আমি আর রাশেদ কিছু স্যুভিনিয়র কিনে নিলাম ভ্রমণের স্মারকচিহ্ন হিসেবে।
রাজশাহীতে আমরা ফিরে ছিলাম পার্শ্ববর্তী সান্তাহার জেলার স্টেশন থেকে ট্রেন যোগে এবং সেই ট্রেন সাকুল্যে লেট করেছিল তিন ঘণ্টা।তবে সেই অভিজ্ঞতা অন্য কোনো দিন শোনাবো।
কথায় আছে 'ভ্রমণ কখনও শেষ হয় না'।বাংলাদেশের বৃহত্তম এই বৌদ্ধ বিহারের সৌন্দর্যও এক ভ্রমণে কাউকে তৃপ্ত করতে পারে বলে মনে হয় না।কাজেই আপনারাও যদি 'প্রাচীন বাংলার চন্দ্রনগরী' সোমপুর বিহার দেখে না থাকেন,তাহলে জায়গাটা ঘুরে ফেলতে পারেন।তবে সেটা অবশ্যই এই করোনাকাল শেষ হওয়ার পর।এ ক'দিন না হয় ধৈর্য ধরে ঘরেই থাকুন,স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।নিজে নিরাপদ থাকলেই তো গোটা পৃথিবী ভালো থাকবে।ততোদিনে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এই দেশটির প্রকৃতিও নিজেকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিক না হয়।
কিবরিয়া লিমন
অর্থনীতি বিভাগ (২য় বর্ষ)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়




Nice
উত্তরমুছুন